অর্থনৈতিক রিপোর্টার
পোশাকখাতের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্তরণের ভূয়সী প্রশংসা করেছে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্থা (ডব্লিউইএফ)। সম্প্রতি ডব্লিউইএফ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে পোশাকখাতে বাংলাদেশকে ‘পাওয়ার হাউস’ দাবি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর একরকমের ধ্বংসাবশেষ থেকে উঠে এসে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। পাট এবং অন্যান্য পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে শুধু পোশাকখাত থেকেই দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটি ৮৪ শতাংশ রফতানি আয় অর্জন করছে। এই রফতানি আয়ের মাধ্যমে একদিকে দেশের দারিদ্র্য দূর হচ্ছে, অন্যদিকে পোশাক কারখানাগুলো বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় বাংলাদেশ ঘুরে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিনিধিদল মন্তব্য করেছিল: ‘দেখে মনে হচ্ছে নিউক্লিয়ার বোমায় আঘাত হানার পরদিন শহরের সকাল যেমন হয়, বাংলাদেশের অবস্থা ঠিক তেমন।’ পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধজয়ের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর। সেখান থেকে কয়েক দশক পর বাংলাদেশ শিল্পনির্ভর অর্থনীতির দিকে যাত্রা শুরু করে। মূলত গত এক দশকে বাংলাদেশ পোশাকখাতকে ভিত্তি ধরে যে পরিমাণ উন্নতি করেছে তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য অনুকরণীয়। গত এক দশকে করোনা-পরবর্তী সময়ের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের গড় জিডিপির পরিমাণ ছিল ৭ শতাংশ এবং মাথাপিছু আয় ছিল আড়াই হাজার ডলার, যা এশিয়ার শক্তিশালী দেশ ভারতের থেকে বেশি। বাংলাদেশের সরকার ব্যবসাকে সহজ ও বিনিয়োগবান্ধব করেছে এবং পোশাকখাতকে শক্তিশালী বেসরকারিকরণের মাধ্যমে উন্নতির শীর্ষে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে বলে বাংলাদেশ অল্প সময়ে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে। বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় তৈরি হওয়া কটন টি-শার্ট, প্যান্ট এবং ডেনিমের পোশাক এখন বিশ্বে সমাদৃত উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফ্রিকার যেসব দেশ অনেক চেষ্টা করেও নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা বদলাতে পারছে না, বাংলাদেশের সাফল্য তাদের জন্য ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশের যা যা আছে একই পণ্য ও লোকবল আফ্রিকার দেশগুলোতে থাকার পরও এ খাতে তারা সুবিধা করতে পারছে না। ২০২২ সালে বিশ্বের ২০ শতাংশ কটন টি-শার্টের বাজার ছিল বাংলাদেশ। এত বিপুল সংখ্যক কটন টি-শার্টের বাজার থাকলেও বাংলাদেশে কটন অর্থাৎ তুলার উৎপাদন বৈশ্বিক হিসাবে মাত্র ২ শতাংশ। যেখানে আফ্রিকার দেশগুলোতে অঢেল তুলার উৎপাদন হয়, সেখানে বাংলাদেশ তুলা উৎপাদন না করেও তুলাজাত পোশাক রফতানিতে এতটা সাফল্য অর্জন করেছে যা একরকমের বিস্ময় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে আফ্রিকার দেশগুলো পোশাকখাতে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে চাচ্ছে। এই সমৃদ্ধির পথে হাঁটতে তারা বাংলাদেশের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছে ডব্লিউইএফ। পোশাকখাতের সমৃদ্ধিকে পুঁজি করে বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। বর্তমানে দেশের ৩ হাজার ৫০০ কারখানায় ৪০ লাখ পোশাকশ্রমিক কাজ করছেন। বাংলাদেশের পোশাক বিশ্বের ১৬৭ দেশে রফতানি হয় এবং এখান থেকে গড়ে ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপর রফতানি আয় অর্জন করে বাংলাদেশ। তবে শুধু সনাতনী ধারায় কাটিং-ফিটিং ও সেলাই দিয়ে পোশাকখাতে রাজত্ব করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের পোশাকখাতের সবচেয়ে বড় শক্তি এর কর্মী। এদের আরও দক্ষ করে পোশাকখাতের যন্ত্রপাতি আধুনিক ও ডিজাইন যুগোপযোগী করে তুলতে পারলে ভবিষ্যতে পোশাকখাতে বাংলাদেশ আরও সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনের লেখক ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের গ্লোবাল ম্যানেজার ফেমি একিনরেবিও নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমি ২০২৩ সালের অক্টোবরে সরেজমিন বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানা পরিদর্শন করেছি। বাংলাদেশের পোশাককর্মীদের সিংহভাগ নারী। আগে ব্যবস্থাপনা বিভাগে নারীদের বিচরণ না থাকলেও দিনকে দিন দেশটিতে নারী শিক্ষার বিস্তার ঘটায় এসব কারখানার ব্যবস্থাপনা পর্ষদেও উচ্চ বেতনে নারীরা কাজ করছেন। এটি বাংলাদেশের উন্নতির ব্যাপারে শুভসংকেত দেয়। যথাযথ সহযোগিতা পেলে এই পোশাকখাতকে পুঁজি করে বাংলাদেশ লিঙ্গবৈষম্য কাটিয়ে উঠতে পারবে।’ বাংলাদেশের পোশাকখাত নিয়ে ডব্লিউইএফের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘আমাদের অনেক সমস্যা, বাধাবিপত্তি আছে। কিন্তু এতসবের পরও উদ্যোক্তাদের চ্যালেঞ্জিং উদ্যোগ ও সরকারের নীতিনির্ধারণের সুফল হিসেবে বাংলাদেশের পোশাকখাত পুরোদমে এগিয়ে যাচ্ছে। গতবছর যেখানে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের পোশাকখাতের প্রবৃদ্ধি ছিল নেতিবাচক, সেখানে বাংলাদেশ সবার চেয়ে ভালো করেছে। করোনাসময়েও পোশাকখাতে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির তুলনায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ বেশি ছিল। গ্যাস-বিদ্যুৎ নিয়ে অনেক সমস্যা থাকার পরও চ্যালেঞ্জিং মনোভাবের জন্য বাংলাদেশের পোশাকখাত এখন বিশ্বে সমাদৃত।’ দেশের পোশাকখাত লিঙ্গবৈষম্য নিরসনে ভূমিকা রাখছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটা সময় নারীরা পোশাকখাতে শুধু শ্রমিক হিসেবে কাজ করত। এখন শুধু শ্রমিক বা কর্মী নয়, এ খাতে ব্যবস্থাপনা পর্ষদেও নারীরা নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে। এ খাতে দ্বিতীয়-তৃতীয় প্রজন্মের অনেক নারী আছেন যারা বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা শেষে পোশাকখাত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় বড় পদে যোগ দিচ্ছেন।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের পোশাকখাত নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা সৃষ্টি হলেও শঙ্কা কাটিয়ে নির্বাচনের পরেই নতুন উদ্যমে আবারও নিজেদের সক্ষমতা জানান দিয়েছে দেশের এই প্রধান শিল্প খাতটি। চলতি বছরের প্রথম ৫০ দিনে ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হিসাবে ৬.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে শুধু জানুয়ারি মাসেই বাংলাদেশের পোশাক রফতানি থেকে অর্জিত আয় ৪ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে ৪৭.৩৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। পোশাক রফতানিকারক সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা মনে করছেন, বৈশ্বিক বাজার ব্যবস্থা বিবেচনা করলে চলতি বছর পোশাক রফতানির মোট আয় ২০২৩ সালকে ছাড়িয়ে গিয়ে দেশের রফতানি আয়ে নতুন মাইলফলক রচনা করবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata